TravelwhereBD

বাংলাদেশ ভ্রমনের উপযুক্ত সময় কখন?

বাংলাদেশ ভ্রমনের উপযুক্ত সময়

১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটা ছোট্ট দেশের নাম বাংলাদেশ। এদেশের সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সুবিশাল পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, ঝর্না, মাঠ ঘাট আকৃষ্ট করে ভ্রমনপিপাসুদের। বাংলার এই চিরচেনা রূপে মুগ্ধ হয়েছেন বহু কবি সাহিত্যিক। বাংলাকে নিয়ে লিখেছেন কবিতা।তাইতো জীবনানন্দ দাশ এই গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যকে রূপসী বাংলা নামে আখ্যায়িত করেছেন।মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা এদেশকে ধনসম্পদপূর্ণ নরক বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।দেশসহ দেশের বাইরে থেকে প্রতিবছর পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যায় এখানে৷প্রায় সারাবছর বাংলাদেশ ভ্রমনের উপযুক্ত সময় হলেও গ্রীষ্মকাল ভ্রমনের জন্য ততটা সুবিধাজনক সময় নয়। তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকায় অসহ্য গরম পড়ে এখানে।  বাংলাদেশের জলবায়ু সামগ্রিকভাবে ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু।ছয় ঋতুর দেশ হলেও গ্রীষ্ম, বর্ষা,ও শীতকালের প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই বাংলা মাস মিলে গ্রীষ্মেকাল। এসময় প্রচুর গরম পড়ে। নদীনালা,খাল বিলের পানি শুকিয়ে যায়।ফসলের মাঠও শুষ্কতায় ফেটে চৌচির হয়ে যায়।তাই এসময় ভ্রমন করাটা খুবই অস্বস্তিকর। 

গ্রীষ্মেকাল কেন ভ্রমনের সঠিক সময় নয়-

বাংলাদেশ ভ্রমনের জন্য সারাবছরই উন্মুক্ত থাকে। তাই বছরের যেকোনো সময় এখানে আসা ঘুরতে আসা যায়।এখানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গড়ে ৩৮° সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২১° সেলসিয়াস। সবচেয়ে উষ্ণতম মাস হিসেবে ধরা হয় এপ্রিল মাসকে। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের তাপমাত্রা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে বলা চলে। ২০২৪ সালে এপ্রিল মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ছিলো অসহ্যনীয়। অত্যাধিক তাপমাত্রায় যেমন রয়েছে স্বাস্থ্যঝুকি তেমনি রয়েছে হিট স্ট্রোকের প্রবণতা। তাই অন্তত এপ্রিল-মে/জুন মাসে এখানে ভ্রমনে না আসাই শ্রেয় বলে আমার মনে হয়। 

গ্রীষ্মকালে সমুদ্র সৈকত ভ্রমন-

গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ৩৮° সেলসিয়াস থাকলেও সমুদ্র এলাকায় তা আরোও বেশী প্রভাব ফেলে। যেমন কক্সবাজার এলাকার গড় তাপমাত্রা প্রতিবছর ৪০-৪৪° সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে যা স্বাভাবিকের তুলনায় অত্যন্ত বেশি। এই সময়ে দিনের বেলা সমুদ্র পাড়ে অবস্থান করাও কষ্টকর। তাই বেশিরভাগ পর্যটক গ্রীষ্মকালে সমুদ্রভ্রমন এড়িয়ে চলেন। 

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত- বাংলাদেশের পর্যটক আকর্ষনের শীর্ষে রয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। প্রতিবছর প্রচুর বিদেশি পর্যটক এখানে ভ্রমনে আসেন। সমুদ্র দেখার পাশাপাশি এখানে রয়েছে আরও কতগুলো দর্শনীয় স্থান যেমন- হিমছড়ি,পাটুয়ারটেক সী বীচ,মেরিন ড্রাইভ,কলাতলী বীচ,সুগন্ধা বীচ ইত্যাদি। এছাড়াও অদূরেই রয়েছে মহেশখালী দ্বীপ,আদিনাথ মন্দির,রাবার বাগানসহ আরও অনেক স্থান। একরাত কক্সবাজারের যেকোনো হোটেলে কাটিয়ে দিতে পারেন অনায়াসে। মোটামুটি এখানে বিভিন্ন মানের এবং বাজেটের অসংখ্য হোটেল রয়েছে। কক্সবাজার ভ্রমনের আদ্যপ্রান্ত 

কুয়াকাটা সী বীচ-বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত একসাথে দেখা যায়। এটি সাগরকন্যা নামেও পরিচিত। পটুয়াখালি জেলার অন্যতম এই স্থানে সারাবছর ভ্রমনপিপাসুদের এত বেশি আনাগোনা না থাকলেও শীতকালে আনাগোনা বেড়ে যায়। কুয়াকাটার আসল সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে মূল বীচের আশেপাশে। কাওয়ার চর,লেবুর চর, ঝিনুক বীচ,তিন নদীর মোহনা, শুটকি পল্লী,রাখাইন পল্লী,লাল কাকড়ার চর, গঙ্গামতির চর ইত্যাদি কুয়াকাটার মূল আকর্ষন। রাতে থাকার জন্য কয়েকটি ভালো হোটেল রয়েছে। বেশিরভাগ হোটেলই মোটামুটি কমের মধ্যেই পাবেন তবে আগের থেকে বুকিং এর দরকার নেই। কুয়াকাটায় সিন্ডিকেট চলে প্রচুর তাই খাবার,হোটেলের ক্ষেত্রে দামাদামি করে নেয়াই ভালো। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ভ্রমন বিস্তারিত

বাশবাড়িয়া সী বীচ– চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাশবাড়িয়াতে অবস্থিত বাশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকতের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর জেটি ঘাট। বীচের তীর থেকে লম্বালম্বিভাবে বহুদূর বিস্তৃত এই জেটিঘাট ধরে হেটে যাওয়া যায় সমুদ্রের মাঝ পর্যন্ত। জোয়ারে জেটির প্রায় পুরোটাই পানিতে তলিয়ে গেলেও ভাটার সময় পুরোটা জেটি দেখা যায়। বাংলাদেশের আর কোনো সমুদ্রে এই দৃশ্য দেখা যায় না। মূলত মাছ ধরার ট্রলারগুলো এই জেটিঘাটে এসে ভিড় করে। আশেপাশে সবুজ কার্পেট ঘাস আর ইউক্যালিপটাস গাছ বীচের সৌন্দর্য আরোও দ্বিগুন করেছে। গ্রীষ্মেকালে এখানে প্রচুর রোদ থাকে তাই গরমে ভ্রমনে না আসাই ভালো।

গুলিয়াখালী সী বীচ-চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় সবুজের গালিচায় মোড়ানো এক ভিন্ন ধাচের সমুদ্র সৈকত এই গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত। বিস্তীর্ণ কার্পেট ঘাসের মাঝে জমে থাকা সমুদ্রের পানি যোগ করেছে অমায়িক সৌন্দর্যের। বর্ষায় প্রচুর পানি থাকায় সবুজ অংশগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায় আবার গ্রীষ্মকালে গরমের উত্তাপে সবুজ ঘাসগুলোর আসল সৌন্দর্য প্রকাশ পায়না। পানি শুকিয়ে পরিনত হয় রুক্ষ মরুভূমিতে। বর্ষার শেষ আর শীতের শুরুতে গুলিয়াখালী বীচ আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে। একদিকে যেমন রুক্ষতা কাটিয়ে ওঠে প্রকৃতি অন্যদিকে পানির পরিমানও তখন কমে আসে। গুলিয়াখালি সমুদ্র সৈকত ভ্রমনের বিস্তারিত জানুন

ঝর্না বা ট্রেকিং ট্যুর- যেকোনো ট্রেকিং ট্যুরে প্রচুর শারীরিক শ্রম দিতে হয় আমরা সকলেই জানি। গরমে এই ধরনের ট্রিপ খুবই ক্লান্তিকর এবং কষ্টদায়ক। প্রচন্ড গরমে ট্রেকিং ট্যুর বা হাইকিং এ হিট স্ট্রোকের প্রবনতাও দেখা দেয়। তাই যথাসম্ভব গরমকালে ট্রেকিং ট্রিপ পরিহার করা উচিত। ট্রেকিং ট্রিপের মধ্যে রয়েছে ঝর্না ট্রেকিং,পাহাড় ট্রেকিং ইত্যাদি। বাংলাদেশে অসংখ্য ঝর্না ও পাহাড় রয়েছে যেখানে প্রচুর পর্যটক ট্রেকিং করে থাকে। বান্দরবান ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পাহাড় এবং ঝর্না ট্রেকিং এর সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি জেলা। 

খৈয়াছড়া,নাপিত্যছড়া,হরিনমারা,বিলাসী,সহস্রধারা,সুপ্তধারা, বোয়ালিয়া,ঝরঝরি ইত্যাদি ঝর্না– চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থিত।এছাড়াও সিলেটের হামহাম ঝর্না ও বান্দরবানের সকল ঝর্না এবং খুম যেমন- নাফাখুম,আমিয়াখুম, ভেলাখুম,সাতভাইখুম বর্তমানে ট্রেকিং এর জন্য খুবই জনপ্রিয়। ঝর্না ট্রেকিং এর উৎকৃষ্ট সময় বর্ষাকাল এটা সবারই জানা। কারন তখন বৃষ্টির পানিতে যৌবন ফিরে পায় সকল ঝর্না। ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রেক করে শীতল ঝর্নায় পানিতে গা ভিজিয়ে নেয়াটাই ঝর্না ট্রেকিং এর চরম শান্তি। গরমকালে কোথায়ও বৃষ্টি না হওয়ায় ঝর্নায় কোনো পানি থাকেনা। শুকনো মৌসুমে সবুজ গাছপালাও ধূসর হয়ে পড়ে। তাই প্রকৃতির সৌন্দর্য আর সেই সাথে ঝর্নার মায়াবি রূপ উপভোগ করতে চাইলে গ্রীষ্মকালে ঝর্না ভ্রমন থেকে আপনাকে বিরত থাকতে হবে। খুম ট্রেকিং এর আদর্শ সময় সাধারনত শীতকাল কারন বর্ষাকালে পানির তীব্র গতি ভয়ংকর রূপ ধারন করে। আবার গ্রীষ্ম কালেও পানি শুকিয়ে যায় বিধায় শুধু পাথর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না। তাই গরমে খুমে ঘুরতে যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছুই নয়।

দ্বীপ ভ্রমন/ক্যাম্পিং ট্যুর-ক্যাম্পিং ট্যুরের বেশিরভাগই দ্বীপ বা একটু নিরিবিলি জায়গাতে হয়ে থাকে। প্রকৃতি খুব কাছে থেকে উপভোগ করতে প্রকৃতিপ্রেমিরা ক্যাম্পিং ট্রিপ বেছে নেয়। বাংলাদেশে নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার নিঝুম দ্বীপ,ভোলার মনপুরা,চর কুকরি-মুকরি,ফেনী জেলার মহুয়ার চর, চট্টগ্রামের সোনাইছড়ি প্রভৃতি স্থান ক্যাম্পিং এর জন্য বিখ্যাত। প্রতিদিনের কোলাহল থেকে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে চাইলে ক্যাম্পিং একটি বেস্ট অপশন। ক্যাম্পিং এর উপকরন যেমন তাবু,বিছানাপত্র ইত্যাদি ভাড়া নেয়ার অপশন আছে অথবা চাইলে নিজেও ক্যারি করতে পারেন৷ যেহেতু তাবু করে থাকতে হয় সেহেতু তাপমাত্রা বা আবহাওয়া অনুকূলে থাকাটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। প্রচন্ড গরমে যেমন টিকে থাকা দায় হয়ে যায় তেমনি বর্ষাকালের প্রচুর বৃষ্টিতে তাবুতে রাতযাপন প্রায় অসম্ভব। আর যেহেতু দ্বীপ এলাকাগুলোতে গ্রীষ্মেকালে কালবৈশাখী ঝড় ব্যপকভাবে আঘাত হানে সেহেতু ভুলেও গ্রীষ্মেকালে দ্বীপ/সমুদ্র এলাকাতে ক্যাম্পিং এর চিন্তা মাথাতেও আনবেন না। 

গ্রীষ্মকালে পাহাড় ট্রেকিং বা হাইকিং- 

পাহাড় ট্রেকিং এর জনপ্রিয় সাইটগুলো হচ্ছে বান্দরবানের কেওক্রাডং, সাকা হাফং,ডিম পাহাড়,মারাইংতং,কির্সতং পাহাড়,দেবতা পাহাড়, সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় ইত্যাদি। এসকল সুউচ্চ চূড়ায় পৌছাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় পর্যটকদের। পাহাড়ে সাধারনত শীতের রাতে ঠান্ডা পড়লেও দিনের বেলা সূর্যের প্রখর তাপ থাকে। গরমকালে তাপমাত্রা আরোও বৃদ্ধি পায় তাই দিনের বেলা ট্রেকিং খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশ ভ্রমনে টিপস এবং সতর্কতা-

গরমকালে যারা বাংলাদেশ ভ্রমন করতে চাচ্ছেন তাদের জন্য কিছু টিপস-

১) একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে বাংলাদেশে গরম থাকলেও এপ্রিল এবং মে এই দুই মাস সর্বচ্চ গরম পড়ে থাকে তাই এই সময়টা এড়িয়ে আসা ভালো।

২)এমন কোনো স্থান বাছাই করুন যেখানে রিল্যাক্সে ঘুরতে পারবেন

৩) তুলনামূলক শীতল স্থান কিংবা গাছপালা রয়েছে এমন জায়গা বেছে নিতে পারেন

৪)ভ্রমনকালে অবশ্যই সাথে পানি,স্যালাইন,ছাতা,সানস্ক্রিন সাথে রাখতে ভুলবেন না। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top