TravelwhereBD

একদিনে টাঙ্গাইলের ৫ জমিদার বাড়ি ভ্রমন

পুরোনো স্থাপত্যশিল্প ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার কিংবা ঘুরে দেখার আগ্রহ আমার অনেক আগের অভ্যাস।এই অভ্যাস থেকেই টুকটাক ঘুরে দেখার ফুসরত মিললেই এদিক সেদিক চলে যাই।পুরাতন বাড়ি, জমিদারদের বিশাল দালান কোঠা বাংলাদেশের প্রায় সবজায়গাতেই কমবেশী ছড়িয়ে আছে। এইসব পুরাতন কীর্তি আমাদের উপলব্ধি করায় বাংলার একসময়ের অঢেল প্রাচুর্যতা। পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন না হয়ে গেলেও খুব বেশী ভালো অবস্থায় আছে এটাও বলা যায় না। আজকের লিখায় তেমনই এক ঐতিহ্যবাহী জেলায় ভ্রমনের গল্প বলতে যাচ্ছি।  ঢাকার গা ঘেষে অবস্থিত টাঙ্গাইল জেলা, আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জেলা।মিষ্টি এবং তাতশিল্প ছাড়াও এই জেলা পুরোনো স্থাপত্যেও নেই পিছিয়ে। এক সময়ের ধনী জমিদারদের মালিকানাধীন অনেক পুরনো বাড়ি হয়ে উঠেছে ভ্রমনের কেন্দবিন্দু। ঢাকা থেকে খুব ভোরে ভ্রমন শুরু করলে মাত্র একদিনেই টাঙ্গাইলে এই সব বাড়ি দেখতে পারবেন।

টাঙ্গাইলের বিখ্যাত পাচ জমিদার বাড়ি-

করটিয়া জমিদার বাড়ি

মহেড়া জমিদার বাড়ি

পাকুল্লা জমিদার বাড়ি

দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি

নাগরপুর জমিদার বাড়ি

পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি 

কিভাবে যাবেন টাঙ্গাইল-

বাস এবং ট্রেন দুইভাবেই টাঙ্গাইল যেতে পারবেন। 

পদ্ধতি ১- বাসে গেলে চলে যেতে হবে মহাখালী। মহাখালী থেকে নিরালা,ঝটিকা,ধলেশ্বরী,বিনিময় ইত্যাদি বাস টাঙ্গাইলের নতুন বাসস্ট্যান্ড নিয়মিত যাতায়াত করে। ভাড়া জনপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা। তবে নিরালা বাস সার্ভিস আমার কাছে ভালো মনে হয়েছে। ২.৫-৩ ঘন্টার মত সময় লাগতে পারে। এছাড়াও ঢাকার আব্দুল্লাহপুর থেকেও টাঙ্গাইলের বাস পাওয়া যায়।

ট্রেনে- ধুমকেতু/পদ্মা এক্সপ্রেস,সিল্কসিটি এক্সপ্রেস, একতা এক্সপ্রেস,চিত্রা এক্সপ্রেস,দ্রুতজান এক্সপ্রেস,লালমনি এক্সপ্রেস, সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, টাঙ্গাইল কমিউটর ইত্যাদি ট্রেন টাঙ্গাইল যাতায়াত করে। ভাড়া- ১১৫ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।স্টেশনের বাহিরে অটো দাঁড়িয়ে থাকে।অটো করে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড চলে যাবেন।পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে বাকিসব গন্তব্যে সহজেই পৌছাতে পারবেন।

1. করটিয়া জমিদার বাড়ি

টাঙ্গাইলের করোটিয়া যেতে হলে নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড আসতে হবে। আর ট্রেনে আসলে তো পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের সরাসরি অটো আছে।অটো ভাড়া ২০ টাকা। এরপর পুরান বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি করোটিয়া যাবার বাস রয়েছে।ভাড়া জনপ্রতি ২০ টাকা। করটিয়া পৌঁছে প্রধান সড়ক থেকে একটি অটোরিকশা নিয়ে করোটিয়া জমিদার বাড়িতে যাই। এতটুকু রাস্তা হেটেই যাওয়া যায়।জমিদারবাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ভেতর থেকে ডাক এলো, “আমাকে কিছু টাকা না দিলে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।” যে লোক বাড়ি দেখাশোনা করে তার হাতে ৫০ টাকা গুজে দিলাম।বিনিময়ে আমাদের প্রবেশ করতে দিলেন। তবে বলে রাখা ভালো এই বাড়িতে এখন আগেরমত প্রবেশ করা যায় না। ভাগ্য খারাপ হলে খালি হাতেও ফিরতে পারেন। পুরাতন এই জমিদারবাড়ির প্রতিটি দেয়ালে দেখা যায় জমিদারদের শিকার করা হরিণের মাথার খুলি ও শিং। আর সেই সময়ের ধারণ করা বিভিন্ন ধরনের ছবি। বাড়ির সমস্ত আসবাবপত্র পুরানো কাঠ দিয়ে তৈরি, যা এখনও শক্ত এবং মজবুত, যদিও কিছু পচে যাওয়ার পথে। শুনেছি এই জমিদাবাড়ি অভিনেতা নাঈমের নানার বাড়ি। তারা থাকেন ঢাকার বারিধারায়। দোতালায় তাদের জন্য  আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা আছে।মালিক থাকাকালীন এখানে প্রবেশ সম্পূর্ন নিষিদ্ধ।জমিদার বাড়িটি দুইটি বড় ভবন নিয়ে গঠিত। সামনের ভাগটা খুব সুন্দর, মাঝখানে একটা বড় পুকুর রয়েছে। দুটো গেট রয়েছে। প্রথম গেট পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। 

2. মহেরা জমিদার বাড়ি-

করোটিয়া জমিদার বাড়ি থেকে মহেড়া জমিদার বাড়ি যাবার প্লান করলাম। প্রধান সড়ক থেকে বাসে মহেড়া নেমে সিএনজি ভাড়া করে চলে গেলাম মহেরা জমিদার বাড়ি। মহেরা জমিদার বাড়িটি বাংলাদেশ সরকার কিনেছিল এবং এখানে বাংলাদেশ পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা জনসাধারণের জন্য প্রবেশ টিকিটের মাধ্যমে উন্মুক্ত। মহেরা জমিদার বাড়িতে মোট তিনটি বড় ভবন, দুটি পুরাতন পুরাতন ভবন এবং সামনে একটি বড় পুকুর রয়েছে।ভবনগুলো যথাক্রমে চৌধুরী লজ, মহারাজ লজ,আনন্দ লজ, কালীচরণ লজ ইত্যাদি। প্রতিটি ভবনের সামনে একটি সুন্দর বাগান রয়েছে। পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হওয়ায় বাড়ির একটি ভবন ডরমেটরি হিসেবে ব্যবহৃত হবচ্ছে।পাশেই একটি মসজিদ দেখলাম।

3. পাকুল্লা জমিদার বাড়ি

মহেরা থেকে পাকুল্লার বাসে উঠলাম। আমাকে বেশিদূর যেতে হলো না।বাস থেকে নেমে হাটতে হাটতে একটা দোতলা জমিদারি বাড়ি দেখতে পেলাম।চারদিকে লাল রঙের দেয়াল করা।বাড়ির সামনে সবুজে আচ্ছাদিত বিশাল মাঠ। এ বাড়িতে এখনো জমিদারের উত্তরাধিকারদের বসবাস রয়েছে। কথা বলে জানা গেলো এরা এই জমিদার বাড়ির ৭ম বংশধর। এর পাশেই বাজারের সাথেই দেলদুয়ার জমিদারের তৈরি শতাব্দী প্রাচীন শাহী জামে মসজিদ অবস্থিত।চাইলে দেখে আসতে পারেন।

4. দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি- 

পাকুল্লা থেকে বিদায় নিয়ে পরের গন্তব্য দেলদুয়ার জমিদার বাড়ি। পাকুল্লা থেকে সিএনজি নিয়ে সরাসরি চলে গেলাম দেলদুয়ার।চাইলে ভেঙ্গে ভেঙ্গেও যাওয়া যায় তবে এতে সময়ের অপচয় হয়। জমিদার বাড়ির রাস্তা দেখেই একটা জমিদার জমিদার ঘ্রান পেতে লাগলাম।বুঝা গেল সেই মাপের জমিদার ছিলেন এই বাড়ীর লোকজন। পাশেই একটা শতবর্ষী পুরোনো মসজিদ আর সামনে বিশাল পুকুর।বাড়ির দুইটা গেইট।কোনো গেইটেই কোনো লোকজন না দেখে হতাশ হয়ে গেলাম।কিছুক্ষন পরে একজন কেয়ারটেকার আসলেন।জানালেন প্রবেশ করা যাবেনা।পরবর্তীতে  অনেক কষ্টের ফলে কেয়ারটেকারকে ম্যানেজ করে কিছুক্ষনের জন্য ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল সবুজ খড়ে মোড়ানো কার্পেটের বিশাল খোলা উঠান। বিশাল আকৃতির শতবর্ষী গাছগুলো সাক্ষী হয়ে আছে এই বাড়ীর প্রতিটি জমিদারের উত্থান ও পতনের ইতিহাসের।বাড়ির পাশেই একটা পারিবারিক কবরস্থান চোখে পড়লো। বাড়ির সকল জমিদারদের কবর এখানে। তাদের জন্মসাল আর মৃত্যুসাল শোভা পাচ্ছে মার্বেল পাথরে খোদাই করে লিখা এপিটাফে।বাড়ীর নাম দেয়া হয়েছে “নর্থ হাউস”। এই বাড়ীটির প্রতিটি ইটের দেয়াল পুরোনো হলেও নতুন ভাবে সংস্কার করা হয়েছে লাল আর সাদা রংয়ের মিশ্রনে।বাড়ির কেয়ারটেকার জানলেন এই বাড়ীর জমিদার ব্রিটিশ আমলের মন্ত্রী ছিলেন।এখানে আর বেশী সময় না নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পরের জমিদারবাড়ীর খোঁজে।

5. নাগরপুর জমিদার বাড়ি-

নাগরপুর জমিদার বাড়ি মূলত নাগরপুর সরকারি মহিলা কলেজ হিসেবে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে। মহিলা কলেজ বিধায় বহিরাগতের প্রবেশ নিষেধ বিশেষত পুরুষদের। তবে ভর্তির সময়ে সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে। এছাড়াও পরিচিত কেও এই কলেজে অধ্যয়নরত থাকলে আপনি প্রবেশ করতে পারবেন। ভাগ্যক্রমে তখন কলেজে ভর্তি চলছিলো। ভিতরে ঢুকে দেখলাম একটা বিশাল দালান, এই ভবনেই কলেজের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিভিন্ন তলায় অনুষদের সাইনবোর্ড টানানো দেখলাম। ভবনটি ৩ তলা। প্রত্যেক তলায় ক্লাস হয়।প্রত্যেকটি রুমের সাথে একটি বারান্দা এটাচ করা থাকলেও সেগুলো বন্ধ। দূর থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ভবনটির দিকে তাকাতেই কেমন এক অদ্ভুদ অনুভূতি হলো। ভাবছিলাম,দিন গড়িয়ে রাত্রিবেলায় কি ভয়ংকর লাগে দেখতে এই দালান।কোনো সংস্কার না হওয়ায় পুরোনো একটা ভাইব পাচ্ছিলাম।তবে এটা সরকারী কলেজ হিসেবে না ব্যবহার করে সংরক্ষনের ব্যবস্থা করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করলে আরও ভালো হত। সামনেই পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত আরেকটি দালান যার সিড়ি ছাড়া আর কোনো কিছুই বাকি নেই। পাশে আরো দুইটা দালান।একটির নাম বাঘা দালান(ওপরে দুইটা বাঘের মূর্তি থাকায় এই নামকরন করা হয়েছে।। দুটি দালানই পরিত্যক্ত। ভিতরের সিড়ি,জানালা,দরজা ভেঙে একাকার।তবে বাইরের কারুকার্য এখনও অনেকটা নিখুত রয়েছে। একটা খাবারের ক্যান্টিন চোখে পড়লো। পিছনের ২ নম্বর দিয়েও কলেজের ভেতরে প্রবেশ করা যায়। তূলনামূলকভাবে খুবই ছোট জায়গা নিয়ে এই জমিদার বাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও এর ইতিহাস,কারুকাজ খচিত দালান আপনাকে অবাক করে দিবে।

টাঙ্গাইলের জমিদার বাড়ি ভ্রমনে সতর্কতা ও টিপস- 

১)একদিনে ঘুরতে চাইলে অবশ্যই খুব ভোরে যাত্রা শুরু করতে হবে।ঢাকার বাইরে থেকে যারা আসবেন তারা রাতে রওনা দিতে পারেন যাতে টাংগাইলে পৌছাতে দেরি না হয়। এছাড়া আগের রাতে টাংগাইল সদরে রাত্রিযাপন করে পরেরদিন সকাল থেকে রিলাক্সে যাত্রা শুরু করা যেতে পারে।

২)সময় বাচাতে এবং সবগুলো জমিদার বাড়ি ঘুরে দেখতে সিএনজি ভাড়া করতে পারেন। সদর ছাড়া বাকি সকল উপজেলায় অটো,রিকশা,সিএনজি চলাচল করে। বারবার ওঠানামা কিংবা যানবাহন পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ এবং ঝামেলাপূর্ণ। 

৩)বেশিরভাগ জমিদার বাড়ির অবস্থা খুবই নাজুক এবং ভঙ্গুর তাই প্রবেশ নিষিদ্ধ সাইনবোর্ড দেখে তা মেনে চলুন।

৪)যাবার এবং ফেরার টিকিট আগের থেকে কেটে রাখুন। ট্রেনে গেলে ট্রেনের শিডিউল জেনে রাখুন আর বাসে গেলে নতুন বাসস্ট্যান্ড চলে আসুন।এখান থেকে ঢাকার মহাখালী পর্যন্ত বাসে যেতে পারবেন। 

৫)পুরোনো জমিদার বাড়িগুলো আমাদের ঐতিহ্য, তাই ঘুরতে গিয়ে পরিবেশ কিংবা এই ঐতিহ্যগুলোর ক্ষতি হয় এমন কিছু করা থেকে দয়া করে বিরত থাকুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top